![]()
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধিঃ শেখ মোঃ আরমান
একদিকে কলেজ জীবন, অন্যদিকে সফল খামারি – বিরল এই সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ঘোড়াদাইড় গ্রামের তরুণ শিক্ষার্থী বি এম সাগর ভূঁইয়া। পারিবারিক চাপ এবং চাকরির অনিশ্চয়তাকে পাশ কাটিয়ে, মাত্র ৫০০ কোয়েল পাখি নিয়ে শুরু করা তাঁর ‘ভূঁইয়া অ্যাগ্রো ফার্ম’ আজ স্থানীয় অর্থনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি এখন প্রতি মাসে নিট ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় করছেন।
স্বপ্নকে ছাপিয়ে উদ্যোগের জন্মঃ
সাগর ভূঁইয়ার স্বপ্ন ছিল চাকরির বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজের মতো কিছু করার। তাঁর বাবা বেলায়েত ভূঁইয়া যখন উন্নত জীবনের আশায় তাঁকে বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা করেন, তখন সাগর সেই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি তিনি বেছে নেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের পথ।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে জমানো ৩৫ হাজার টাকা পুঁজি করে তিনি প্রথম শুরু করেছিলেন মুরগির খামার। তবে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার অভাবে প্রথম উদ্যোগেই তাঁকে বিপুল লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। অদম্য এই যুবক জানান, “প্রথম ব্যর্থতা আমাকে দমাতে পারেনি। লোকসানের কথা পরিবারকে না জানিয়েই আমি নতুন কিছু করার পরিকল্পনা করি এবং কোয়েল পালনে মনোনিবেশ করি।”
সেই দৃঢ়তা থেকেই জন্ম নেয় আজকের সফল ‘ভূঁইয়া অ্যাগ্রো ফার্ম’।
সাফল্যের চাবিকাঠি: গবেষণা ও আধুনিক পদ্ধতি
সাগরের খামার এখন শুধু ৫০০ কোয়েল পাখির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমানে তাঁর ফার্মে রয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোয়েল পাখি। তিনি গতানুগতিক ডিম বিক্রির পাশাপাশি আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করে বাচ্চা উৎপাদন শুরু করেন।
“বর্তমানে প্রতিদিন আমরা প্রায় ৯০০ ডিম সংগ্রহ করি। তবে সবচেয়ে বড় সফলতা এসেছে ইনকিউবেটর মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে। এই মেশিন ব্যবহার করে আমরা প্রতি মাসে প্রায় ২০ হাজার কোয়েল বাচ্চা ফোটাতে সক্ষম হচ্ছি,” জানান তরুণ উদ্যোক্তা সাগর।
এই ব্যাপক উৎপাদনের ফলে সাগর এখন প্রতি মাসে প্রায় ১৫ হাজার কোয়েল পাখি বাজারে সরবরাহ করছেন। প্রতিটি পাখির পেছনে খরচ বাদ দিয়ে তাঁর ৭ থেকে ১০ টাকা লাভ থাকে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে তাঁর উৎপাদিত কোয়েল পাখি এখন পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন জেলায়।
স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাবঃ
সাগর ভূঁইয়ার এই সফলতা এলাকার যুব সমাজকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। তাঁর সহপাঠী আহম্মদ উল্লাহ বলেন, “সাগর ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীল ছিল। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও এখন কোয়েল পালনে আগ্রহী হয়েছি এবং একটি ছোট খামার গড়ার পরিকল্পনা করছি।”
একই গ্রামের নূর আলম জানান, তিনি সাগরের কাছ থেকে উন্নত মানের ২০০ স্ত্রী কোয়েল পাখির বাচ্চা কিনেছেন। তিনি বলেন, “শীতকালে কোয়েলের ডিমের চাহিদা বাড়ে এবং লাভও ভালো হয়। কোনো সমস্যা হলে সাগরের কাছ থেকে দ্রুত পরামর্শ পাই।” এই ধরনের উদ্যোগ স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বাড়াতে সাহায্য করছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গোবিন্দ চন্দ্র সরকার বিষয়টিকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তিনি বলেন, “কোয়েল পালন খুবই লাভজনক। একটি কোয়েল জন্মের মাত্র ৪৫ দিনের মধ্যে ডিম দিতে শুরু করে। আমরা এই তরুণ খামারিকে সব ধরনের পরামর্শ ও কারিগরি সহযোগিতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।”
সাগর ভূঁইয়ার গল্প প্রমাণ করে, প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়েও সঠিক পরিকল্পনা, শ্রম ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার একজন কলেজছাত্রকে স্বনির্ভরতার শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। তিনি এখন শুধু একজন ছাত্র নন, হাজারো যুবকের জন্য প্রেরণার উৎস।



মন্তব্য