![]()
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি: শেখ মোঃ আরমান
আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদে জড়িয়ে প্রাণ হারালেন বাংলাদেশের দুই তরুণ। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রতন ঢালী (২৪) এবং তাঁর সঙ্গী ফয়সাল হোসেন (২২) পাকিস্তানের নিষিদ্ধ ঘোষিত সশস্ত্র গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান (টিটিপি)-এর হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর এক যৌথ অভিযানে এই দুই বাংলাদেশি নিহত হন বলে জানা গেছে। এই মর্মান্তিক ঘটনা দেশের তরুণদের চরমপন্থায় ঝুঁকে পড়ার এবং আন্তর্জাতিক জিহাদি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার গভীর উদ্বেগকে সামনে এনেছে।
সুদূর পাকিস্তানে যেভাবে মৃত্যুঃ
দেশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স (সিটিটিসি) ইউনিটের সূত্রমতে, গোপালগঞ্জের হরিচরপুর গ্রামের বাসিন্দা রতন ঢালী ও ফয়সাল হোসেনের নিখোঁজ থাকার বিষয়টি গোয়েন্দাদের সন্দেহের জন্ম দেয়। তাদের তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য:
যাত্রা শুরু: রতন ও ফয়সাল গত বছরের ২৭ মার্চ বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন।
পথ পরিবর্তন: ভারত থেকে তারা অবৈধভাবে আফগানিস্তানে যান এবং সেখান থেকে তারা পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তান এলাকায় পৌঁছান।
যোগদান: পাকিস্তানে পৌঁছেই তারা টিটিপি’র জঙ্গি কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।
সিটিটিসি’র সুপার রওশন সাদিয়া আফরোজ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযানে ৫৪ জন টিটিপি যোদ্ধা নিহত হওয়ার পর গোয়েন্দা তদন্ত শুরু হয়। নিহতদের মধ্যে সাভারের আহমেদ জুবায়ের ওরফে যুবরাজ নামে আরেক বাংলাদেশির পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরই রতন ও ফয়সালের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে আসে। জানা গেছে, এই দুজনই এর আগে ঢাকার একটি ইজামা সেন্টারে কাজ করতেন।
শোকে পাথর বাবা-মা: “আমার ছেলে বেঁচে আছে, না মরে গেছে?”
নিহত রতন ঢালীর পরিবার আজও তাদের ছেলের প্রকৃত পরিণতি সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে। প্রায় ১৮ মাস ধরে নিখোঁজ থাকা রতনের বাবা-মা, পেশায় অটোরিকশাচালক আনোয়ার ঢালী এবং সেলিনা বেগম, এখনো আশা-নিরাশার দোলাচলে ভুগছেন।
মুকসুদপুরের সিন্ধিয়াঘাট পুলিশ ফাঁড়ির নিকটস্থ নিজ বাড়িতে শোকার্ত মা সেলিনা বেগম জানান, ২০২৪ সালের রোজার ঈদে শেষবার ভিডিও কলে ছেলের সঙ্গে কথা হয়।
সেলিনা বেগম (মা): “ও (রতন) বলেছিল, ‘মা, আমি দুবাই যাচ্ছি। আমি এখন দিল্লিতে আছি।’ পরে অনেক দিন পর একবার অন্য একজনের ফোন দিয়ে কল দিয়েছিল। বলেছিল, ‘আমার ফোন পানিতে পড়ে গেছে।’ এরপর আর তার সঙ্গে কথা হয়নি।”
রতনের বাবা আনোয়ার ঢালী জানান, মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ ছেড়ে ঢাকায় একটি ইজামা সেন্টারে কাজ শুরু করার পর থেকেই রতন কেমন যেন পাল্টে যেতে শুরু করে।
আনোয়ার ঢালী (বাবা): “দুবাই যাওয়ার কথা বলে সে কাগজপত্র নিয়ে যায়। তাকে যে পাঠাচ্ছিল, আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রতন বলেছিল, এতে তার দুবাই যাওয়ায় সমস্যা হবে। পরে পুলিশ দুবার তাকে খুঁজতে বাড়িতে এসেছিল।”
মগজ ধোলাই ও নেটওয়ার্কের বিপদঃ
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, রতন ও ফয়সালকে সুকৌশলে ধর্মীয় কাজের আড়ালে উগ্রবাদী কেন্দ্রে যুক্ত করা হয়েছিল। দুর্বল অর্থনৈতিক পটভূমি এবং শিক্ষার অভাবকে কাজে লাগিয়ে তাদের মগজ ধোলাই করা হয় এবং উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের পথে ঠেলে দেওয়া হয়।
এই ঘটনা বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাসমূহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। দেশের অভ্যন্তরে পরিচালিত উগ্রবাদী নেটওয়ার্কগুলোর অস্তিত্ব, যারা তরুণদের বিদেশে জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করছে, তাদের মূলোৎপাটন করা এখন সময়ের দাবি। এই ঘটনা প্রমাণ করে, সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার এবং জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য।



মন্তব্য