অনলাইন ডেস্ক
৩৬ জুলাই—এটি কোনো ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়, এটি একটি ইতিহাসের নাম। ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাস। ২০২৪ সালের এদিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের গণআন্দোলনের পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন তার ছোট বোন শেখ রেহানাও। অবসান ঘটে ১৫ বছরের শাসনপ্রক্রিয়ার। কোটা সংস্কার আন্দোলনের হাত ধরে ইতিহাসের পৃষ্ঠা ওলটায় বাংলাদেশ। ৩৬ জুলাই সেই জাগরণেরই রক্তাক্ত প্রহর, যার পরদিন ভোরে এক নব্য গণতান্ত্রিক সূর্যোদয় দেখা দেয়।
দ্বিতীয় দফায় দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত বছরের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া রায়ের ওপর ভিত্তি করে। সে রায়ে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করলে কোটা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে আবারো আন্দোলন শুরু হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষও যুক্ত হয়। হামলা, মামলা ও নির্যাতন করেও এ আন্দোলন দমন করতে পারেনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের আন্দোলনের মাথায় পতন ধ্বনি বাজে সরকারের।
মূলত ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা হাইকোর্টে একটি রিট করেন। হাইকোর্ট ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর এই কোটা পরিবর্তনের পরিপত্রটিকে বাতিল করে দেয়। ফলে সব ধরনের কোটা আবার পুনর্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ফলস্বরূপ, কোটা পদ্ধতি আবারও পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। শুরু হয় ছাত্রদের প্রতিরোধ। সরকার আপিল করে। উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা।
১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে তিন দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন; ২ জুলাই গণপদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত চার কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত হয় এই পদযাত্রা; ৩ জুলাই দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা; ৪ জুলাই উত্তাল হয়ে ওঠে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগ স্থগিত করেনি; ৫ জুলাই আবারো বিক্ষোভ।
৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়; ৭ জুলাই বাংলা ব্লকেড নামে নতুন কর্মসূচি পালিত হয়। এতে রাজধানী স্থবির হয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন; ৮ জুলাই ঢাকার ১১টি স্থানে অবরোধ, ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ, ৩ স্থানে রেলপথ অবরোধ এবং ৬টি স্থানে মহাসড়ক অবরোধ করা হয়; ৯ জুলাই সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
১০ জুলাই কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ। সেদিন সব গ্রেড সংস্কারের দাবি জানায় শিক্ষার্থীরা; ১১ জুলাই পুলিশের বিভিন্ন বাধার মুখে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়; ১২ জুলাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে; ১৩ জুলাই রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়; ১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়। সেদিন মধ্য রাতে ক্যাম্পাসগুলো বিক্ষোভ পালিত হয়। এদিন চীন সফর শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে’? এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তারা স্লোগান দিতে থাকে ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি নও, আমি নই, রাজাকার, রাজাকার’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’ইত্যাদি; ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের স্লোগানের ব্যাপারে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঔদ্ধত্বের জবাব দেবে ছাত্রলীগ’। সেদিনই কোটাবিরোধীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা হয়।
১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীসহ সারাদেশে ৬ জনের মৃত্যু হয়। আবু সাঈদের মৃত্যুর দৃশ্য ব্যাপক হারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে; ১৭ জুলাই ছাত্র বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা ও কফিন নিয়ে মিছিল পালন করে শিক্ষার্থীরা। এদিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানান; ১৮ জুলাই সর্বাত্মক অবরোধ বা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালিত হয়। এতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। সরকার আন্দোলনকারীদের আলোচনার জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু ছাত্ররা তা প্রত্যাখান করেন; ১৯ থেকে ২১ জুলাই তিন চার দিন ধরে সংঘর্ষ চলে। কয়েকদিনে সরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা ১৫০ জন হলেও বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা দাঁড়ায় আড়াই শতাধিক।
২০ জুলাই সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়; ২১ জুলাই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৭ সদস্যের বেঞ্চ কোটা নিয়ে রায় প্রদান করেন। সেখানে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ, খ-মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, গ-ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং ঘ-শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়; ২২ জুলাই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান যাত্রাবাড়ী এলাকা পরিদর্শন শেষে বলেন, ‘জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে।’ ২৩ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সামনে বক্তব্যে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘গুজব প্রতিরোধে কাজ করছে বিদেশের মিশনগুলো’। ২৪ জুলাই ঢাকাস্থ বিদেশি মিশনপ্রধান ও কূটনিতিকদের নিয়ে আন্দোলনে ৪টি স্থানের ধ্বংসযজ্ঞ দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সংবাদ সম্মেলন করেন। একই দিন গণভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোটা আন্দোলনকারীদের একদিন জাতির কাছে জবাব দিতে হবে, কেন তারা তাদের দেশে এই ধ্বংসযজ্ঞের সুযোগ দিল।’
কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২৫ জুলাই দেশের বিভিন্ন রাজনৈতি দলের নেতাকর্মীদেরও গ্রেফতার করা হয়; ২৬ জুলাই, শুক্রবার ধানমন্ডিতে সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নিরীহ মানুষ হত্যার দায় বিএনপি ও জামায়াতের।’ এদিন হাসপাতাল থেকে তিন সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে ডিবি পুলিশ জোরপূর্বক মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে আসে; পরের দিন ২৭ জুলাই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকেও ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে আসা হয়। ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে ভোররাতে ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হয়। এদিন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে নিয়েছি।’ এদিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের নামে ডিবি কার্যালয় থেকে একটি ভিডিও বার্তা গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয়, সার্বিক স্বার্থে আমরা এই মুহূর্ত থেকে আমাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি।
২৯ জুলাই সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ ৬ সমন্বয়ককে দেখতে ডিবি অফিসে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রাণের মূল্য কোটি কোটি টাকার চেয়ে অনেক বেশি।’
এদিকে এদিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে আন্দোলনে নিহতের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা রাষ্ট্রীয় শোককে প্রত্যাখান করে চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচার কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেন। সাথে সাথে দেশকে স্থিতিশীল করতে নয় দফা দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। ৩০ জুলাই রাত থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের ডিবি অফিসে আটক অবস্থায় অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। পরবর্তীতে সে খবর জানামাত্র সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুলাহ ও নুসরাত তাবাসসুমও অনশন শুরু করেন। প্রায় ৩২ ঘণ্টারও অধিক সময় অনশনের পরে ডিবি প্রধান ছয় সমন্বয়ককে মুক্তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিলে অনশন ভাঙা হয়। সারা দেশে আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়। অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের ডাকে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তুলেন। কেউ কেউ ফেসবুকের প্রোফাইলও লাল করেন। ৩১ জুলাই মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচির পালন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ। এদিনের কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’।
১ আগাস্ট দুপুর দেড়টায় ৬ সমন্বয়ককে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। ২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে বসার আহ্বান জানান। তারা তা প্রত্যাখান করেন; ৩ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল পালিত হয়। ঘোষণা করা হয় সরকারের পদত্যাগের একদফা। ৪ আগস্ট থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে দেশ। ৫ আগস্ট ভোর রাত থেকেই ঢাকার পথে যাত্রা করে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। এতে করে রাজধানী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। দুপুর আড়াইটায় শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন। বিকাল ৪টায় সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ-জামান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। রাস্তায় আনন্দ মিছিল। এক নতুন সকাল ধীরে ধীরে বাংলাদেশের উপর উদয় হয়। ৩৬ জুলাই কেবল একটি আন্দোলনের দিন নয়—এটি একটি নতুন রাষ্ট্রচিন্তার সূচনা। একটি প্রজন্মের হাতে লেখা গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের দিন।
মন্তব্য