নিজস্ব প্রতিবেদক
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বিতর্কিত ব্যক্তিদের প্রশাসনিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকা নিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে। সেই আলোচনার মধ্যেই উঠে এসেছে আরেক আলোচিত নাম সিদ্ধেশ্বরী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শেখ জুলহাস উদ্দিন। আওয়ামী শাসনামলে দুর্নীতির অভিযোগ এবং ক্ষমতাসীন দলের দোসর হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। বর্তমান সময়ে তার অপসারণের দাবিতে সিদ্ধেশ্বরী কলেজের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের তদবিরে ২০১৮ সালে শেখ জুলহাস অধ্যক্ষের পদ দখল করেন। এরপর থেকেই কলেজটি পরিণত হয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অপকর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে। অভিযোগ রয়েছে, ভোলা-৩ আসনের সাবেক এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ঢাকা ৮ আসনের সাবেক এমপি রাশেদ খান মেনন এবং পরবর্তীতে একই আসনের বাহাউদ্দিন নাসিমের প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায় শেখ জুলহাস কলেজে দুর্নীতি, দমন-পীড়ন এবং স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে গেছেন বছরের পর বছর।
অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল শিক্ষাঙ্গন
গত ৩০ জুলাই ২০২৫ থেকে সিদ্ধেশ্বরী কলেজের সামনে, মৌচাক মোড়, শাহজাহানপুর মোড়, প্রেস ক্লাব, মাউশি এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এলাকায় ব্যানার ও পোস্টারে শেখ জুলহাসের অপসারণের দাবিতে সরব হয়ে ওঠে সচেতন শিক্ষার্থীরা। পোস্টারগুলোর ভাষা ছিল, “৪ আগস্ট শেখ হাসিনার সাথে গণভবনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নস্যাৎ করার পরিকল্পনাকারী, আওয়ামী শিক্ষক সংগঠন বাকশিসের আহবায়ক শেখ জুলহাস উদ্দিনের অপসারণ চাই।”
পোস্টারে শেখ জুলহাসের নানা অপকর্মের চিত্রসহ প্রমাণ সংযুক্ত করা হয়। ওই কলেজের একজন শিক্ষার্থী বলেন, “অধ্যক্ষ শেখ জুলহাস এই কলেজকে আওয়ামী ক্যাডার তৈরির কারখানায় পরিণত করেছিলেন সেই আমলে। এখন সময় হয়েছে তার বিদায়ের।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান ছাত্র আন্দোলন দমনে অর্থের যোগানদাতা
২০২৪ সালের জুলাই মাসে যখন সারা দেশে ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধে, তখন শেখ জুলহাস কঠোর হুমকি দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নিতে নিষেধ করেন। কলেজের তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা শিশির ও লিনাজের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার বিরোধী শিক্ষকদের হুমকি দেয়া হয় এবং গণ অভ্যুত্থান রুখতে ছাত্রলীগ কে মোটা অংকের টাকা দিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করেন।
৪ আগস্ট ২০২৪ তারিখ রাতে গণভবনে শেখ হাসিনার ডাকা পেশাজীবী ও অধ্যক্ষদের বৈঠকে শেখ জুলহাসের উপস্থিতি প্রমান করে সে একজন চুড়ান্ত ফ্যাসিস্ট ।
অভিযোগের পাহাড়:
শেখ হাসিনার আমলে নিজের বংশীয় নাম ‘‘শেখ’’ ব্যবহার করতেন হাসিনার সাথে মিলিয়ে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল স্বার্থ হাসিল করা। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকেই শেখ জুলহাস নিজ নামের বংশীয় পদবীর বানান বদলে “সেখ” লিখতে শুরু করেন — যা শিক্ষার্থীদের চোখে ধরা পরে এবং তাদের ভাষায়, এটি তার চাতুর্যের প্রতীক। বর্তমানে শেখ জুলহাস নিজেকে বিএনপির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিতে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে ছবি তুলে তার ফেসবুকে প্রচার করে থাকেন যাতে ভবিষ্যৎ রাজনীতির পালাবদলে তার পদ অক্ষুন্ন থাকে।
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ বাণিজ্য ও দাপ্তরিক দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি ঢাকার মধুবাগে অন্তত ৫ কোটি টাকা দামের ৩টি ফ্ল্যাট, তার নিজ জেলা বাগেরহাটের রামপালে বিস্তৃত জমি ও বাড়ির মালিক হয়েছেন।
রাজনীতির নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফ্যাসিবাদ
২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় ঢাকা-৮ আসনের এমপি পদপ্রার্থী নাসিমের প্রচারণায় সিদ্ধেশ্বরী কলেজ ব্যবহার করা হয়। ক্লাস বন্ধ করে কলেজ অডিটোরিয়ামে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক বসিয়ে আওয়ামীলীগ প্রার্থী নাসিমের উপস্থিতিতে নির্বাচনে কারচুপির কৌশল শেখানো হয়। এভাবে শেখ জুলহাস নিয়মিত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন এবং নিজেকে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বলে প্রচার করতেন।
ছাত্ররাজনীতি সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, অধ্যক্ষ জুলহাস উদ্দিন কলেজে বিরোধীদলের ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রম দমন করতেন এবং তোষণ করতেন আওয়ামীপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ কে। “আমাদের কোন অনুষ্ঠান করতে দিত না, কিন্তু ছাত্রলীগের সবকিছুতে অনুমতি দিতেন উনি,” বললেন এক ছাত্রনেতা।
নারী শিক্ষকাকে কুপ্রস্তাব ও বরখাস্ত
একাধিক শিক্ষকেরা অভিযোগ করেছেন, অধ্যক্ষ শেখ জুলহাস নিয়মিত নারী শিক্ষিকাদের তার ব্যক্তিগত কক্ষে ডাকেন। অন্তত ৪ জন নির্ধারিত নারী সহকর্মী রয়েছে তার যাদের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িত তিনি। সম্প্রতি অন্য এক নারী শিক্ষিকা তার কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে বিধিবহির্ভূতভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। প্রতিবাদ করায় তাকে জীবননাশের হুমকিও দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব ঘটনায় জুলহাসের আপন ছোট ভাই ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক শেখ জিয়াউর রহমান ও আপন চাচাতো ভাই লাইব্রেবী প্রভাষক মো: রুবেলও জড়িত।
বর্তমানে আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; রাজনৈতিক দলগুলোর তরফ থেকেও জোরালো দাবি উঠেছে তার অপসারণের। প্রগতিশীল ছাত্র জোট, গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম ও একাধিক রাজনৈতিক দলের ঢাকা মহানগর ইউনিট অধ্যক্ষ শেখ জুলহাসের অপসারণ দাবিতে ফুসে উঠেছেন।
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এখনও তিনি বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা । তারা বলছেন, শেখ জুলহাসের বহাল থাকা প্রমাণ করে প্রশাসনের ভেতরে এখনো একটি ‘আওয়ামী প্রভাবশালী চক্র’ সক্রিয় আছে।
আওয়ামী শাসনামলে গড়ে ওঠা বিতর্কিত ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকা নিয়ে দেশজুড়ে বাড়ছে বিক্ষোভ । সিদ্ধেশ্বরী কলেজের অধ্যক্ষ শেখ জুলহাস উদ্দিনকে ঘিরে চলমান আন্দোলন এই প্রেক্ষাপটেই বড় এক ইঙ্গিত দিচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন কোন পথে এগোয় তা দেখার অপেক্ষায় গোটা কলেজপাড়া।
মন্তব্য