মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
 

খালেদা জিয়া: এক মহামানবীর চিরঅবসান

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫

---

রিয়াজুল ইসলাম
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক উজ্জ্বল অধ্যায় আজ চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল। বিএনপি চেয়ারপারসন, তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আপসহীন আন্দোলনের প্রতীক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর নেই। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৬টায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার ইন্তেকালে গোটা দেশ শোকস্তব্ধ।

বিএনপি মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজে প্রথমে তার মৃত্যুর খবর জানানো হয়। পরে বিএনপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশিত এক শোকবার্তায় বলা হয়—“বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ সকাল ৬টায় ফজরের ঠিক পরে ইন্তেকাল করেছেন। আমরা তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং সকলের নিকট দোয়া প্রার্থনা করছি।”

দীর্ঘ চিকিৎসা ও সংকটময় সময়

গত ২৩ নভেম্বর থেকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন খালেদা জিয়া। দীর্ঘদিন ধরে তিনি আইসিইউতে ছিলেন এবং তার শারীরিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন আগেই জানিয়েছিলেন—তিনি এক কঠিন সংকটময় সময় পার করছেন। শেষ পর্যন্ত সব চিকিৎসা প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে আজ ভোরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।

শৈশব থেকে রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার পথ

বেগম খালেদা জিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট, দিনাজপুর জেলায়। তার পিতা ইস্কান্দার মজুমদার এবং মাতা তৈয়বা মজুমদার। শৈশবেই তার শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়ন করেন।

১৯৬০ সালে তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিনি ফার্স্ট লেডি হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং বিভিন্ন সামাজিক ও কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন।

রাজনীতিতে অনিবার্য প্রবেশ

১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের পর দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক সংকটময় অধ্যায় শুরু হয়। সেই সময় জাতির প্রয়োজনে রাজনীতিতে এগিয়ে আসেন খালেদা জিয়া।
১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগ দিয়ে শুরু হয় তার রাজনৈতিক যাত্রা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি দলের নেতৃত্বে উঠে আসেন—১৯৮৩ সালে ভাইস-চেয়ারম্যান, ১৯৮৪ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী

আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে তিনি ছিলেন আপসহীন নেতৃত্বের প্রতীক।
তিনি গঠন করেন সাত দলীয় জোট, ঘোষণা দেন—স্বৈরাচার পতন না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। এই আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার তাকে কারাবরণ ও গৃহবন্দী থাকতে হয়। এই আপসহীন অবস্থানের কারণেই তিনি পরিচিতি পান ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে।

প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বেই দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়—যা তার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম ঐতিহাসিক অর্জন।

তার শাসনামলে শিক্ষা ও সামাজিক খাতে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার মধ্যে রয়েছে—বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, উপবৃত্তি কর্মসূচি, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে ৩০ বছরে উন্নীতকরণ।

বিরোধী নেত্রী থেকে আবার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন

১৯৯৬ সালের জুনে নির্বাচনে পরাজিত হলেও তিনি সংসদে বৃহত্তম বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট গঠন করে ২০০১ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও অনন্য রেকর্ড

২০০৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনে বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ২৯তম স্থান। বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে কোনো আসনে পরাজিত না হওয়া একমাত্র প্রধানমন্ত্রী। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি স্টেট সিনেট কর্তৃক ‘গণতন্ত্রের যোদ্ধা’ উপাধি

কারাবরণ, মামলা ও শেষ মুক্তি

২০১৮ সালে একটি বিতর্কিত মামলায় তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা দেশ-বিদেশের বহু আইন বিশেষজ্ঞ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই বিচারের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
পরবর্তীতে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একে একে সব মামলায় খালাস পান তিনি।

অবসান এক যুগের

বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শুধু বিএনপিই নয়—বাংলাদেশ হারালো এক সংগ্রামী রাষ্ট্রনায়ককে, যিনি জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন কারাগার, আন্দোলন ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে।

তার প্রয়াণে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া।
আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন।

মন্তব্য

সর্বশেষপঠিত

এলাকার খবর

Developed By: Dotsilicon