জাবি প্রতিনিধি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে এক প্রার্থীকে জুলাইয়ের হামলাকারীকে নিয়ে প্রচার-প্রচারণা করতে দেখা গেছে। একই প্রচারণায় দেখা গেছে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন সাবেক কর্মীকেও।
কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সম্মিলিত জোট ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ থেকে সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক (নারী) পদে অংশ নেওয়া জান্নাতুল ফিরদাউস আনজুমকে ১৫ জুলাই রাতে জাবি উপাচার্যের বাসভবনে ছাত্রলীগের হামলাকারী হিসেবে অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৫০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহফুজ গাজীকে সাথে নিয়ে প্রচার করতে দেখা গেছে। একইসাথে হল ছাত্রলীগের পলিটিক্যাল ব্লকে থাকতো এমন শিক্ষার্থীদেরও দেখা যাচ্ছে এই নারী প্রার্থীর প্রচারণায়।
১৫ জুলাই জাবি ভিসির বাসভবনে হামলাকারী মাহফুজ গাজী, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের প্রার্থী আনজুমের প্রচারণায়
জুলাইয়ের হামলায় সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৫০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহফুজ গাজীকে নিয়ে তদন্ত কাজ চলমান আছে বলে নিশ্চিত করেন অধিকতর তদন্ত কমিটির সচিব লুৎফুর রহমান আরিফ। তিনি বলেন, একটা সিন্ডিকেট সভায় যারা হামলাকারী ছিল তাদের বিচার কার্য সম্পন্ন করা হয়েছে। ঠিক একই সময়ে ভিডিও ফুটেজ দেখে আরও বেশ কয়েকজনকে আইডেন্টিফাই করা হয়েছে, সেখানে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মাহফুজ গাজীর নাম রয়েছে। নতুন নাম আসা শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আগামি সিন্ডিকেটে একটি তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে অভিযুক্ত হামলাকারীকে সাথে নিয়ে প্রচারণার এই ঘটনাকে অনেকেই জাকসু নির্বাচন বানচাল করার প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন। অনেক প্রার্থী আবার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন।
বামপন্থীদের একাংশের প্যানেল ‘সংশপ্তক পর্ষদ’র সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী জাহিদুল ইমন বলেন, প্রচারণায় জুলাইয়ে হামলায় অংশগ্রহণ করা আমাদের জন্য আশঙ্কাজনক। যার বা যাদের ব্যাপারে তদন্ত চলমান আছে তারা প্রচারণায় অংশ নেওয়া তো দূরের কথা তাদের তো ক্যাম্পাসেই থাকার কথা না, যতক্ষণ পর্যন্ত না বিচার কার্যক্রম শেষ হচ্ছে। প্রশাসনের কাছে দাবি জানাব, অনতিবিলম্বে ওই প্রার্থীর প্রার্থীতা বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি যেই প্যানেল থেকে নির্বাচন করছে সেই প্যানেলের সবাইকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা।
শিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’র সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী মাজহারুল ইসলাম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জুলাইয়ে হামলাকারী সন্ত্রাসী নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের অনেককে নানা ফ্রেমিংয়ে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে, এটি তার একটি প্রয়াস কিনা সেটা আমাদের প্রশ্ন থাকবে। নির্বাচন কমিশনারকে এই ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো প্রকার আস্ফালন মেনে নেওয়া হবে না।
বাগছাস সমর্থিত ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’র সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী তৌহিদ সিয়াম বলেন, যারা ফৌজদারি অপরাধে জড়িত তাদের নিয়ে প্রচার করলে খুবই দুঃখজনক। এটা নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা হিসেবে দেখি।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত সহ-সভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী শেখ সাদি বলেন, এই ধরনের চিহ্নিত অপরাধীদের নিয়ে যারা প্রচারণা চালাচ্ছে তারাও অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে। কোনো প্রার্থী অপরাধীদের নিয়ে মাঠে থাকার দুঃসাহস দেখাতে চাইলে আমরা সেটা কখনোই মেনে নেব না, বরদাশতও করব না। প্রশাসনের উচিত হবে বিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তূলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের যুগ্ম মূখ্য সমন্বয়ক মেহরাব সিফাতের বান্ধবী হিসেবে জাবি ক্যাম্পাসে পরিচিত জান্নাতুল ফিরদাউস আনজুম। জানা গেছে, স্বতন্ত্রপ্রার্থী দাবি করলেও এনিসিপি নেতা মেহেরাব সিফাতের প্রার্থী হিসেবে কাজ করছেন আনজুম।
তবে এই ব্যাপারে জান্নাতুল ফিরদাউস আনজুমের সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
এনসিপি নেতা মেহেরাব সিফাত বলেন, আনজুম ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন না। সবাই জানে যে হল থেকে ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে যেতো অনুষ্ঠানে। হয়তো তেমনই কোন অনুষ্ঠানেরই তার কোন ছবি আছে। তবে তিনি তার প্রচারণায় কোন ছাত্রলীগ কর্মী রেখেছেন কি না এ ব্যাপারে আমার ধারণা নেই। আমি তাকে কোন প্যানেল বা প্রার্থী হিসেবে সমর্থন করছি না। তবে হ্যাঁ, যদি ওর বা যে কারো পলিটিকাল ভিউ আমার সাথে মিলে, তাহলে আমি সে জায়গা থেকে তাকে একজন ব্যাক্তি হিসেবে সমর্থন করি। কোন প্রার্থী হিসেবে নয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত নই। তবে আমি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী। সেই জায়গা থেকে আমি যে কাউকে সমর্থন করতে পারি।
এদিকে খোজ নিয়ে জানা যায়, আনজুম ফ্যাসিবাদী আমলে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। গত বছরের ২১ নভেম্বর রাজধানীর সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে উপস্থিত হোন তিনি এবং সেটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে।
এনসিপি নেতা মেহেরাব সিফাতের সাথে সেনাকুঞ্জে যাওয়ায় ছাত্রলীগ কর্মী আনজুমকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়
সোশ্যাল মিডিয়া একটিভিস্ট জাওয়াদ নির্ঝর তার ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেন- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির ৮ নম্বর সদস্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেহেরাব সিফাতের গার্লফ্রেন্ড, ছাত্রলীগের কর্মী জাবির চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফিরদাউস আনজুম। সিফাত তার গার্লফ্রেন্ড আনজুমকে নিয়ে সেনাকুঞ্জে যান। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে ফ্যাসিবাদবিরোধীদের ভাগ্যে কী আছে, আল্লাহ জানে।
এছাড়া আনজুমকে ছাত্রলীগের নানা কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেও দেখা যায়। ব্যানারসহ ছাত্রলীগের আনন্দ র্যালি কিংবা অন্যান্য প্রোগ্রামেও ছিল তার সক্রিয় অংশগ্রহণ।
চারুকলা বিভাগে তৃতীয় বর্ষে থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগ নেতৃদের সাথে আনজুম
হামলাকারী নিয়ে প্রচারণার ব্যাপারে জানতে চাইলে জাকসু নির্বাচন কমিশন সদস্য সচিব অধ্যাপক রাশিদুল আলম বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। হামলাকারী জাকসু নির্বাচনের প্রচারণা করছে এরকম যদি অভিযোগ পাই তাহলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিব।
স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন জোট থেকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী নিভির ভূইয়া বলেন, আমি নিজের প্রচারণায় ব্যস্ত। সেজন্য জানিনা কে কাকে নিয়ে প্রচার করছে। তবে জুলাইয়ে হামলাকারীদের নিয়ে যদি কেউ প্রচার করে তাহলে অবশ্যই গর্হিত কাজ।
স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন জোট থেকে সহ-সভাপতি প্রার্থী (ভিপি) আব্দুর রশিদ জিতু গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের স্বতন্ত্র প্যানেলে সহ-সমাজসেবা (নারী) পদে নির্বাচন করছেন আনজুম। তিনি জুলাই অভ্যুত্থানে সম্মুখসারির যোদ্ধা ছিলেন। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটিতে ছিলেন এবং পরে যখন এ কমিটি ভেঙে যায়, তখন তিনি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সাথে যুক্ত হন। এরপর সে সেখান থেকে পদত্যাগ করে এককভাবে একটিভিজম শুরু করেন এবং স্বতন্ত্র নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন।
জুলাইয়ের হামলাকারী নিয়ে প্রচারণার বিষয়ে জানতে চাইলে এই ভিপি প্রার্থী বলেন, আমাদের প্যানেলে কোন বিতর্কিত বা সমালোচিত কাওকে রাখিনি। তবে প্রচারের সময় আনজুমের তার সাথে ছাত্রলীগের হামলাকারী কেউ থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে তা যদি প্রামাণিত হয় তাহলে আমরা প্যানেলের সকলে মিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব।
স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীদের প্যানেল হওয়ার পরও এনসিপির কোন নেতা সমর্থন দিচ্ছে কি না এই ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে প্রকাশ্যে যদি তার হয়ে এনসিপির কোন নেতা প্রচারণা না করে, তাহলে সে বিষয়টি আমরা খারাপভাবে দেখছি না।
মন্তব্য