বিশেষ প্রতিনিধি: রাজধানীর মিরপুর এলাকায় Salvation Islamic School and College-এর ঠিক পাশেই বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে যা রাজউকের অনুমোদিত নকশা এবং ভবন নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এর একাধিক ধারা লঙ্ঘন করে গড়ে উঠছে বলে রাজউক চূড়ান্তভাবে জানিয়েছে। অথচ সকল নিষেধাজ্ঞা ও নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে ভবনের নির্মাণ কাজ চালু রয়েছে। নিচতলায় “Flat For Sale” সাইনবোর্ডে প্রকাশ্যে ফ্ল্যাট বিক্রিও চলছে।
রাজউকের চূড়ান্ত নোটিশে চিহ্নিত অনিয়মসমূহ:
রাজউকের ৩ নাম্বার জোনাল অফিস থেকে গত ২৩/০৯/২০২৪ খ্রি: তারিখ ২৫.৩৯.০০০০.০৯৯.৩২.১১৮.২৪.২৫১ নং স্মারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং গত ০৫/১১/২০২৪ খ্রি: তারিখ ২৫.৩৯.০০০০.০৯৯.৩২.১১৮.২৪.৩৬৪ নং স্মারকে মেহেরা ইসলাম গং, বাড়ি নং ৩১৯, আহমেদ নগর, সলিম উদ্দিন মার্কেট রোড, Salvation Islamic School and College সংলগ্ন মিরপুর, ঢাকা-১২১৬ ঠিকানায় ভবনের মালিক বরাবর প্রেরিত চূড়ান্ত নোটিশ-এ উল্লেখ রয়েছে যে:
১. অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয়:
ভবনের সম্মুখে অনুমোদিত নকশার সেটব্যাক নূন্যতম ৩.৫১/২.৪০ মিটার জায়গা অনুমোদিত থাকলেও নির্মিত হয়েছে ১.৩৭ মিটার। ডেভিয়েশন করা হয়েছে ২.১৪/১.০৩ মিটার।
পেছনে অনুমোদিত নকশার সেটব্যাক নূন্যতম ৩.০০/২.৮৭ মিটার জায়গার স্থলে নির্মাণ ১.২২ মিটার। ডেভিয়েশন করা হয়েছে ১.৮৭/১.৬৫ মিটার।
ডান পাশে অনুমোদিত নকশার সেটব্যাক নূন্যতম ৪.০৫/৩.০৫ মিটার থাকার কথা থাকলেও সরেজমিনে সেটব্যাক নির্মাণ করা হয়েছে মাত্র ১.১০ মিটার। ডেভিয়েশন করা হয়েছে ২.৯৫/১.৯৫ মিটার।
বাম পাশে অনুমোদিত নকশার সেটব্যাক নূন্যতম ২.১৪/১.৫৫ মিটার করার কথা থাকলেও সরেজমিনে সেটব্যাক ৩.৩৫/১.৩৭ মিটার। ডেভিয়েশন করা হয়েছে ০.১৮ মিটার।
২. নিরাপত্তা লঙ্ঘন:
ভবনের নির্মাণ অত্যন্ত সংকীর্ণ রাস্তার পাশে এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ লাইনের নিচে গড়ে তোলা হয়েছে, যা জনগণের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
৩. অবৈধ দখল ও ভবন প্রবেশপথ বাধা:
ভবনের পূর্ব এবং পশ্চিম পাশে যাতায়াতের পথ নেই, যা ভবন বিধিমালা ২০০৮ এর ৫.০১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গুরুতর লঙ্ঘন।
৪. বিদ্যমান ভবনের সীমানা লঙ্ঘন করে নতুন নির্মাণ:
পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তর পাশে সীমা রেখা অতিক্রম করে নির্মাণ করা হয়েছে।
রাজউক স্পষ্টভাবে জানায়, এসব অনিয়ম Town Improvement Act, 1953 এর ৫(৭) ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ এবং তিন কার্যদিবসের মধ্যে কার্যক্রম বন্ধ না করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সরেজমিন পরিস্থিতি: নোটিশের ৭ মাস পরও নির্মাণ কাজ অব্যাহত রয়েছে।
প্রতিবেদকের সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়:
পাঁচতলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ চলমান।
“Flat For Sale” বোর্ড টানিয়ে আগেভাগেই ফ্ল্যাট বিক্রি শুরু।
সামনের রাস্তাটি অতি সংকীর্ণ, পাশেই বিদ্যুৎ খুঁটি এবং খোলা বৈদ্যুতিক সংযোগ – যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
নির্মাণ স্থলে কর্মীরা জানান, নোটিশের পরও তাদের কাজ বন্ধ করার নির্দেশ আসেনি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ:
সরেজমিনে অনুসন্ধানকালে এলাকার এক দোকানদার বলেন: “ভবনের কাজ দিনে-রাতে চলছে। রাজউকের লোকজন একদিন এসে কাগজ দিয়েছিল, কিন্তু কিছুই বন্ধ হয়নি। বরং নিচে ফ্ল্যাট বিক্রির ব্যানার ঝুলানো আছে!”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, পাশের বাসিন্দা জানান, “এত কাছে বিদ্যুৎ লাইন, এত উঁচু ভবন – আমাদের বাসায় আলো-বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। আগুন লাগলে রক্ষা নাই।”
অন্য একজন বাসিন্দা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের এলাকার রাস্তা এমনিতেই সংকীর্ণ। এত বড় ভবন হলে জ্যাম আরও বাড়বে। দুর্ঘটনা হলে ফায়ার সার্ভিস কীভাবে ঢুকবে?”
আইনি অবস্থান: উচ্চ আদালতের রায় ও নজির:
নিয়মবহির্ভূত ভবন নির্মাণ ও অনিয়মে রাজউক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে ইতিপূর্বে উচ্চ আদালতে একাধিক রায় প্রদান করা হয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স:
১. Human Rights and Peace for Bangladesh (HRPB) Vs. RAJUK & Others – Writ Petition No. 9989 of 2015
আদালত নির্দেশ দেন, “জননিরাপত্তা ও পরিবেশ লঙ্ঘন করে অনুমোদিত নকশা বহির্ভূত নির্মাণ অবৈধ এবং তা ধ্বংসযোগ্য।”
২. Writ Petition No. 2841 of 2017
নির্মাণ বিধিমালা লঙ্ঘনের প্রেক্ষিতে অনুমোদন বাতিল এবং ভবন অপসারণের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
৩. Appellate Division Judgment – Civil Appeal No. 132 of 2012
আদালত বলেন, “জনস্বার্থে আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা; রাজউকের গাফিলতি তাদের দায়মুক্তি দেয় না।”
৪. Writ Petition No. 5616 of 2020 (RAJUK Case)
রাজউকের অনুমোদন ছাড়া নির্মাণ কাজে জড়িত প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ।
পরিবেশ ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা:
পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশিকা অনুযায়ী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫০ মিটারের মধ্যে বহুতল ভবন নির্মাণে বিশেষ পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্কুলের মাত্র ২ মিটার দূরত্বে নির্মাণ হচ্ছে, যা পরিবেশ আইনও লঙ্ঘন করে।
বিদ্যুৎ বিভাগের নিরাপত্তা নির্দেশিকা:
ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি (ডেসকো) এর নিরাপত্তা নির্দেশিকা অনুযায়ী, উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ লাইনের ১০ মিটারের মধ্যে ভবন নির্মাণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এই ভবনটি মাত্র ৩ মিটার দূরত্বে নির্মিত হচ্ছে।
অভিযোগ: দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা:
চূড়ান্ত নোটিশ জারি করে কী কারণে ভবন মালিকের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন সংশ্লিষ্ট জোনের দায়িত্বে নিয়োজিত অথরাইজড অফিসার প্রকৌশলী শেগুফতার শারমিন আশরাফ।
ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে। আমি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব না।”
রাজউকের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “এ ধরনের বেশ কিছু ফাইল আটকে আছে। রাজনৈতিক চাপ এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়া:
পরিবেশ আইনজীবী সমিতির একজন আইনজীবী বলেন, “এ ধরনের অবৈধ নির্মাণ শুধু আইন লঙ্ঘন নয়, এটি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনবে। রাজউকের এই নিষ্ক্রিয়তা অগ্রহণযোগ্য।”
স্থাপত্য ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, “পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য ভবন বিধিমালার কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি। এই ধরনের লঙ্ঘন ঢাকার নগর পরিকল্পনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।”
প্রতিবেশী দেশের অভিজ্ঞতা:
ভারতের দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ডিডিএ) এ ধরনের লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে ভবন ভাঙার নজির রয়েছে। সিঙ্গাপুরে বিল্ডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন অথরিটি (বিসিএ) তাৎক্ষণিক নির্মাণ বন্ধের পাশাপাশি জরিমানা ও কারাদণ্ডের ব্যবস্থা রয়েছে।
ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বিশ্লেষণ:
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের অবৈধ নির্মাণ ভবিষ্যতে বেশ কিছু সমস্যার জন্ম দিতে পারে:
- ভূমিকম্পের সময় কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে বিপর্যয়।
- অগ্নিকাণ্ডের সময় দমকল বাহিনীর প্রবেশে বাধা।
- নর্দমা ও পানি নিষ্কাশনে সমস্যা।
- এলাকার যানজট বৃদ্ধি।
- পার্শ্ববর্তী ভবনের ভিত্তি দুর্বল হওয়া।
বিশেষজ্ঞ মতামত:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্বান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, “রাজউকের এই ধরনের নিষ্ক্রিয়তা ঢাকা শহরের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য মারাত্মক হুমকি। আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা আরও অনেক মানুষকে আইন লঙ্ঘনে উৎসাহিত করবে।”
বুয়েটের প্রকৌশলী বিভাগের একজন অধ্যাপক জানান, “এই ধরনের সেটব্যাক লঙ্ঘন ভবনের কাঠামোগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এটি মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।”
বিশ্লেষণ ও প্রস্তাবনা:
এ ধরনের নির্মাণ ও কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা শুধুই আইন লঙ্ঘন নয়, এটি জননিরাপত্তা, নগর পরিকল্পনা ও সুশাসনের চরম অবমূল্যায়ন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি নোটিশ দিয়েও ব্যবস্থা না নেয়, তবে জনগণের আস্থা কোথায় থাকবে?
তাৎক্ষণিক প্রস্তাবনা:
১. নির্মাণ কাজ অবিলম্বে বন্ধ করা হোক।
২. রাজউক ও DESCO’র যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ সরানো হোক।
৩. দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজউক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
৪. ফৌজদারি মামলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হোক।
৫. মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজকে এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হোক।
দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ:
১. রাজউকের অভ্যন্তরীণ তদারকি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা।
২. ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালু করা।
৩. নিয়মিত জরিপের মাধ্যমে অবৈধ নির্মাণ শনাক্তকরণ।
৪. জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের সাথে নিয়মিত সমন্বয়।
৫. আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
এই ঘটনা শুধু মিরপুরের একটি স্থানীয় সমস্যা নয় - এটি পুরো ঢাকা শহরের অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ ও দুর্বল গভর্নেন্সের প্রতিফলন। জরুরি ভিত্তিতে এর সমাধান না হলে ভবিষ্যতে আরও মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
মন্তব্য