আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের ধীরগতির কারনে অনুমোদিত নকশার বিপরীতে চলছে ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণকাজ।
নার্গিস রুবি: রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদিত নকশার বিপরীতে গিয়ে একটি আবাসিক ভবনের নির্মাণকাজ অব্যাহত রয়েছে। কাওলা নামাপাড়া মেইন রোড ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত এই ভবনটি নিয়ে রাজউক কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে চূড়ান্ত নোটিশ জারি করেছেন বলে জানা গেছে।
অনিয়মের বিস্তারিত বিবরণ:
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর উত্তরা জোনাল অফিস ২/২ এর আওতাধীন কাওলা, নামাপাড়া, দক্ষিণখান, ঢাকার ঠিকানায় আব্দুল্লাহ আল মমিন ও তার সহযোগীরা সি.এস দাগ নং ২০৬৫ (অংশ), আর এস দাগ নং-৪৪০০ (অংশ), সিটি জরিপ দাগ নং-৩১৩৮২ (অংশ) এর জমিতে রাজউকের কাছ থেকে একটি বেজমেন্টসহ ১০ তলা আবাসিক ভবন (A-2 Type) নির্মাণের অনুমোদন পেয়েছিলেন। অনুমোদন স্মারক নং ২৫.৩৯.০০০০.১০৮.৫৬.০৬৭.২০২২ অনুযায়ী এই অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল।
কিন্তু রাজউকের সাইট পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, ৯ তলা পর্যন্ত নির্মিত এই ভবনে অনুমোদিত নকশার সাথে মারাত্মক বিচ্যুতি রয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনে যে অনিয়মগুলো ধরা পড়েছে তার মধ্যে রয়েছে:
- অনুমোদিত এরিয়ার চেয়ে বেশি বিস্তৃত বারান্দা নির্মাণ।
- অননুমোদিত ছাদ সম্প্রসারণ।
- নির্মাণস্থলে প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত সাইনবোর্ডের অনুপস্থিতি।
- শ্রমিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে ব্যর্থতা।
রাজউকের নোটিশ ও পদক্ষেপ:
গত ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে রাজউকের উত্তরা ২/২ জোনাল অফিসের অথরাইজড অফিসার মাসুক আহমেদ স্মারক নং ২৫.৩৯.০০০০.০৯১.৩২.১৬৪.২৪-২৮৫ এর মাধ্যমে ভবন মালিকদের কাছে কারন দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছিলেন।
নোটিশে বলা হয়েছে, ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২ ও তৎসংশোধনী আইনের ৩বি ধারা অনুযায়ী নির্মিত/নির্মাণাধীন ইমারতের বিচ্যুতিকৃত অংশটুকু কেন ভেঙে অপসারণ করার আদেশ প্রদান করা হবে না, সে বিষয়ে ৭ দিনের মধ্যে লিখিত কারণ দর্শাতে হবে। ব্যর্থ হলে রাজউক আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে সকল নির্মাণকাজ বন্ধ রাখতে হবে।
আইনী কাঠামো ও লঙ্ঘনের পরিমাণ:
এই অনিয়ম একাধিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হচ্ছে:
ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২:
- ধারা ৩(১): কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন ব্যতীত কোনো ইমারত নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ বা পরিবর্তন নিষিদ্ধ।
- ধারা ১২: এই আইনের বিধান লঙ্ঘনকারী সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড অথবা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয়।
- ধারা ১৫: অনুমোদনহীন নির্মাণ ভেঙে ফেলার ক্ষমতা।
রাজউক আইন, ১৯৫৩:
- ধারা ৭৩(১): অনুমোদিত নকশার বিপরীতে নির্মাণে কর্তৃপক্ষ নির্মাণকাজ বন্ধের নির্দেশ দিতে বাধ্য।
- ধারা ৭৪: অবৈধ নির্মাণ অপসারণের ক্ষমতা।
- ধারা ৭৫: অনিয়মের জন্য জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC), ২০২০:
- ধারা ১.৪.৩: নির্মাণস্থলে অনুমোদিত নকশা, অনুমোদনপত্র ও সাইট ইন্সপেকশন বুক রাখা বাধ্যতামূলক।
- ধারা ২.১.৪: নকশা পরিবর্তনে পূর্বানুমতি আবশ্যক।
রাজউক ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮:
- ধারা ৪.২(১): নকশা বহির্ভূত নির্মাণ দণ্ডনীয় অপরাধ।
- ধারা ১৪(১): সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা এবং/অথবা অবৈধ নির্মাণাংশ ভেঙে ফেলার বিধান।
নিরাপত্তা ঝুঁকি ও বিশেষজ্ঞ মতামত:
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, অনুমোদিত নকশার বাইরে নির্মাণ ভবনের কাঠামোগত নিরাপত্তায় মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে। বিশেষত ঢাকার মতো ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় এ ধরনের অনিয়ম বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা এই অনিয়মকে রাজধানীর অপরিকল্পিত নগরায়ণের একটি উদাহরণ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, এটি শুধু একটি ভবনের সমস্যা নয়, বরং নগর পরিকল্পনায় বিদ্যমান দুর্বলতা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতার অভাবের প্রতিফলন।
সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব:
অপরিকল্পিত এই নির্মাণ এলাকার অবকাঠামোতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ অনুযায়ী:
- এলাকার নর্দমা ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিয়েছে।
- যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে ।
- পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় অতিরিক্ত চাপ পড়ছ।
রাজউকের অবস্থান:
এ বিষয়ে রাজউক উত্তরা জোন-২/২ এর ইমারত পরিদর্শক কামরুজ্জামান বলেন, “ভবন মালিককে চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। জবাব না পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অথরাইজড অফিসার মাসুক আহমেদ জানান, আমার জানা মতে, ভবন মালিকে চুড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তথাপিও “ইমারত পরিদর্শককে বিষয়টি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেব। অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এ ধরনের আশ্বাস আগেও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি।
আদালতের নির্দেশনা:
বিভিন্ন সময়ে আদালত এ ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের নির্দেশনা দিয়েছেন:
- রিট পিটিশন নং ৪৫৬৭/২০০৯ এ হাইকোর্ট নকশাবহির্ভূত নির্মাণের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
- সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রাজউককে নিয়মিত পরিদর্শন ও আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের বাধ্যবাধকতার কথা বলেছেন।
বিশেষজ্ঞ সুপারিশ:
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞরা নিম্নলিখিত পদক্ষেপের সুপারিশ করেছেন:
১. তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা: অবৈধ নির্মাণকাজ অবিলম্বে বন্ধ করা এবং অতিরিক্ত অংশ ভেঙে ফেলার আদেশ প্রদান।
২. কাঠামোগত নিরাপত্তা পরীক্ষা: বিদ্যমান কাঠামোর নিরাপত্তা মূল্যায়নের জন্য স্বতন্ত্র প্রকৌশল পরীক্ষা।
৩. আইনি ব্যবস্থা: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ।
৪. নিয়মিত তদারকি: রাজউকের পরিদর্শন ব্যবস্থা জোরদারকরণ।
৫. জনসচেতনতা: নিয়মতান্ত্রিক নির্মাণের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
দক্ষিণখানের এই ঘটনা রাজধানীর অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও প্রশাসনিক তদারকির দুর্বলতার একটি স্পষ্ট উদাহরণ। আইনী কাঠামো বিদ্যমান থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগের অভাবে এ ধরনের অনিয়ম অব্যাহত থাকছে। জননিরাপত্তা ও পরিকল্পিত নগর উন্নয়নের স্বার্থে এই অনিয়মের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
প্রতিবেদন প্রস্তুতকাল পর্যন্ত ভবনের মালিক বা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য পাওয়া গেলে পরবর্তী প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
মন্তব্য