মাজহারুল হাসান রাকিব,যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিলেও এখনও বিচার বিভাগে ঘাপটি মেরে বসে আছেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলে নিয়োগকৃত কর্মকর্তারা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে তারা নিজ নিজ জায়গায় সক্রিয় রয়েছেন। এই বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হাসিনার ফ্যাসিবাদকে সুসংহত করতে বিচার বিভাগীয় যেসব কর্মকর্তা সর্বান্তকরণে দেহ-মন ঢেলে দিয়েছিলেন তাদের অপসারণে বিলম্ব হলে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। নিকট অতীতে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এরই মধ্যে অধস্তন আদালতের আইনজীবী কমিউনিটি থেকে বিচার বিভাগীয় ১৭০ কর্মকর্তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বারের আইনজীবীরা প্রকাশ করেছেন অন্তত ৫০ দলবাজ বিচারপতির তালিকা। ‘দলবাজ’ বিচারপতি উল্লেখ করে এসব বিচারপতির নিয়োগ বাতিল করে নতুন করে তাদের নিয়োগ দিয়ে বিচার বিভাগের মর্যাদা ফেরাতে দাবি তুলেছেন তারা।
ঢাকা বারের আইনজীবীদের দেয়া এ তালিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমকে প্রলম্বিতকরণে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও জামিনবাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। জামিনযোগ্য ধারায় দায়েরকৃত একটি মামলায় এই বিচারক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার কাছে প্রিয়পাত্র হওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে আনিসুল হকের নির্দেশে তিনি এ আদেশ দেন। এই বিচারক এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো: মেহেদী হাসান ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বহাল রয়েছেন এখনো। দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের রায় দেন তিনি। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে রায়ে মূল অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে দেয়া এবং কাউকে কাউকে খালাস দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি একটি রিসোর্টে মাদক ও নারীসহ ধরা পড়েন মেহেদী হাসান।
সেটেলমেন্ট কোর্টের অতিরিক্ত জেলা জজ মো: শওকত হোসেন অতি দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত। নামে-বেনামে তার রয়েছে সম্পদের পাহাড়। বিপুল অর্থ পাচার করেছেন বিদেশে।
বর্তমানে সিরাজগঞ্জ আদালতের অতিরিক্ত জেলা জজ মোহাম্মদ এরফানউল্লাহ। আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এই বিচারকও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। চরম বিএনপিবিদ্বেষী এরফানউল্লাহ ভুয়া মামলায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতাদের রিমান্ডে পাঠিয়েছিলেন।
ঢাকা বারের আইনজীবীরা কট্টর আ’লীগ সমর্থক এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের বেনিফিশিয়ারি ১৭০ বিচারকের তালিকা দিয়ে অবিলম্বে তাদের অপসারণ দাবি করেছেন। এর মধ্যে ঢাকার সিজেএম সৈয়দ মাশফিকুল ইসলাম, গাজীপুরের সিএমএম মো: কায়সারুল ইসলাম, একই জেলার সিজেএম মো: মোস্তাফিজুর রহমান, নরসিংদীর সিজেএম মোল্লা সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জের সিজেএম উৎপল ভট্টাচার্য, গোপালগঞ্জের সিজেএম মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন ভুঁইয়া, নারায়ণগঞ্জের সিজেএম মো: আব্দুর রহমান, চট্টগ্রামের সিজেএম কাজী শহিদুল ইসলাম, একই জেলার সিএমএম মো: রবিউল আলম, ফেনীর সিজেএম মোহাম্মদ আতাউল হক, কুমিল্লার সিজেএম সাউদ হাসান, চাঁদপুরের সিজেএম মো: নূরুল আলম সিদ্দিকী, চাপাই নবাবগঞ্জের সিজেএম কুমার শিপন মোদক, বগুড়ার সিজেএম মো: মনিরুজ্জামান, খুলনার সিজেএম সুনন্দ বাগচী, ঝিনাইদহের সিজেএম মো: আল-আমীন মাতুব্বর, সাতক্ষীরার সিজেএম এস এম আশিকুর রহমান, চুয়াডাঙ্গার সিজেএম মো: লুৎফর রহমান শিশির,নড়াইলের সিজেএম মো: কবিরউদ্দিন প্রমাণিক, বরিশালের সিজেএম মুহিবুল হাসান, ভোলার সিজেএম শরীফ মোহাম্মদ সানাউল হক, সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল মোমেন, রংপুরের সিজেএম মো: সূরুয সরকার, একই জেলার সিএমএম এ এফ আহসানুল হক, কুড়িগ্রামের সিজেএম আলমগীর কবির শিপন, ঠাকুরগাঁওয়ের সিজেএম নিত্য নন্দ সরকার, ময়মনসিংহের সিজেএম মো: মোমিনুল ইসলাম, জামালপুরের সিজেএম মো: মাসুদ পারভেজ, নেত্রকোনার সিজেএম মোস্তাক আহমেদ, আইন মন্ত্রণালয়ের আইন এবং বিচার বিভাগে উপসচিব হিসেবে কর্মরত এ কে এম ইমদাদুল হক, এস মোহাম্মদ আলী, আইন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (রেজিস্ট্রেশন) আবু সালেহ মো: সালাহউদ্দিন খান, মন্ত্রণালয়ের অধীন ডেপুটি সলিসিটর শফিকুল ইসলাম, মো: শাহাবুদ্দিন, উপসচিব মোহাম্মদ রহমত আলী,
আইন সচিব গোলাম সারোয়ারের একান্ত সচিব এস এম মাসুদ পারভেজ, আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে কর্মরত মুরাদ জাহান চৌধুরী, সুব্রত ঘোষ শুভ, যুগ্ম সচিব (মতামত) উম্মে কুলসুম, ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুর রহমান, আরাফাতুল রাকিব, রাজেশ চৌধুরী, অতি দুর্নীতিগ্রস্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে রয়েছেন মোহাম্মদ জসিমউদ্দিন, মোহাম্মদ শেখ সাদী, মো: আতাউল্লাহ, হবিগঞ্জের অতিরিক্ত সিজেএম মো: সাইফুল আলম চৌধুরী, ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো: মইনুল ইসলাম, মো: নূরুল হুদা চৌধুরী, মো: মেহেদী হাসান, আহমেদ হুমায়ুন কবির, তাহমিনা হক, মো: জাকী আল ফারাবী, মো: রাশিদুল আলম, আফনান সুমি, তারিকুল ইসলাম, মো: মামুনুর রশিদ, ঢাকার স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আলাওল আকবর, ওয়াসিম শেখ, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল দেব, ঢাকার অতিরিক্ত সিএমএম মো: হাসিবুল হক, কক্সবাজার সিজেএম আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফেনীর অতিরিক্ত জেলা জজ কেশব রায় চৌধুরী, ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের কিজারত জুলফিকার হায়াৎ, খুলনা এন্টি টেররিজম ট্রাইব্যুনালের বিচারক জাহিদুল কবির, ঢাকার স্পেশাল জজ শেখ হাফিজুর রহমান, নরসিংদীর জেলা জজ মাহবুবুর রহমান সরকার, শেরপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক কামরুন নাহার রুমি, ময়মনসিংহের স্পেশাল জজ ফারহানা ফেরদৌস, ঢাকা মেট্রোপলিটন দায়রা জজ আসসামছ জগলুল হোসেন, আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত ড.এবিএম মাহমুদুল হক, মো: রুস্তম আলী, অতিরিক্ত জেলা জজ মো: আব্বাসউদ্দীন, যুগ্ম জেলা জজ ওয়ায়েজ আল কুরুনী, মামুনুর রশিদ, যশোর জেলা জজ শেখ নাজমুল আলমের নামও রয়েছে।
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে দলবাজ ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বেনিফিশিয়ারি হিসেবে ৫০ বিচারপতির তালিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসান, বিচারপতি মো: রেজাউল হাসান, বিচারপতি শেখ মো: জাকির হোসেন, বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠকুর, স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভে ‘অযোগ্য’ বিচারপতি মো: আমিনুল ইসলাম, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি জে বি এম হাসান, বিচারপতি মো: রূহুল কুদ্দুস, বিচারপতি মো: খসরুজ্জামান, বিচারপতি খিজির হায়াত, বিচারপতি মো: আশরাফুল কামাল, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের, বিচারপতি মো: মজিবুর রহমান মিয়া, বিচারপতি এসএম মাসুদ হোসাইন দোলন, বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি কেএম ইমরুল কায়েশ, বিচারপতি মো: বদরুজ্জামান, বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দ, বিচারপতি মো: মাহমুদ হাসান তালুকদার, বিচারপতি মো: আখতারুজ্জামান, বিচারপতি মো: নজরুল ইসলাম তালুকদার, বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান। বিশ্বজিৎ দেবনাথের নাম রয়েছে।
এছাড়া সরকারের সরাসরি সুবিধাভোগী, কোটা আন্দোলনে হাইকোর্টের সীমানার বাইরে বিক্ষোভকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলার নির্দেশ বলে অভিযোগ রয়েছে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার মুন্সী মশিয়ার রহমান, সরকারের সরাসরি সুবিধাভোগী আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ সাইফুর রহমান, হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার (বিচার) এস কে তোফায়েল হাসান, হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার আলমগির মুহাম্মদ ফারুকি, বিচারপতি খাইরুল হকের সাবেক পি এস প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিব হাসান মো আরিফুর রাহমান, সরকারের সরাসরি সুবিধাভোগী হাইকোর্ট বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান, শামীম সুফি ও কাজী আরাফাত উদ্দিন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী বলেন, যে ভাইরাস ও দলবাজির কারণে ছাত্রজনতা প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতির পদত্যাগ চেয়েছেন এবং হয়েছে। তার থেকে বেশি ভাইরাস ও দুর্নীতি এবং দলবাজির অভিযোগ রয়েছে হাইকোর্টের এমন অনেক বিচারপতি রয়েছে আমরা তাদের পদত্যাগ চাচ্ছি। কারণ এই দলবাজদের রেখে বিচার বিভাগের সংস্কার সম্ভব নয়। প্রধান বিচারপতির কাছে দাবি বিচার বিভাগের সংস্কারের স্বার্থে অবিলম্বে তাদের পদত্যাগ করতে হবে।
মন্তব্য