মো: আমিনুল হক, ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি:
মানুষের জীবন কখনো কখনো গল্পকেও হার মানায়। ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ি ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী রায়পুর গ্রামে বসবাস করেন এমনই এক নিরবে আলো ছড়ানো গীতিকার – আবু সিদ্দিক। বয়স এখন ৭৩, কিন্তু মন তাঁর এখনো নবীর প্রেমের গান সদ্য ফোটা গোলাপের মতো কোমল। যিনি নিজ হাতে লিখেছেন ৫০ থেকে ৬০টির অধিক বিরহ, নবীর শান ও আধ্যাত্মিক সাধনার গান, অথচ একটিও ছাপা হয়নি কোনো বইয়ে, বাজেনি মঞ্চে, উচ্চারিত হয়নি টেলিভিশনের পর্দায়।
নয় মাস বয়সে গীতি কবি বাবাকে হারান, এতিম জীবন আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে বড় হওয়া এই মানুষটি কখনো স্কুলের পাকা ভবনের ছায়া পাননি। বাল্যশিক্ষা পরার পর তাঁর শিক্ষাজীবন থেমে গিয়েছিল বাল্যকালে – কাঁধে উঠেছিল সংসারের দায়। অথচ বুকের ভেতর জেগে উঠেছিল এক অভিমানী লেখনিও ভাব , যিনি কলমের কালিতে লিখে গেছেন জীবনের বেদনা, ভালোবাসা আর প্রিয় নবীর প্রেম।
এক হাতে হাল চাষ - আরেক হাতে কলম ধরা – এমন গীতি কবির সংখ্যা আজ হাতে গোনা। আবু সিদ্দিকের গানে আছে চোখ ভেজানো আবেগ, জীবনের গভীর উপলব্ধি আর এক পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক জগৎ। তিনি লিখেছেন মাটির কাছাকাছি থেকে, সাধারণ মানুষের ভাষায় – কিন্তু তাঁর ভাব ছিল আকাশছোঁয়া।
???? গীতিকার আবু সিদ্দিকের লেখা ও সুর করা জনপ্রিয় একটি গান:
যদি হই গুনাগার তবুও তো বান্দা তোমার, ডাকি বারে বার কাতরে মাফ কর গো দয়াল আমারে।
* কত কত পাপী করিয়াছ মাফি,
তারাই তো সুখী আমায় রাখলা দূরে। আমার দুঃখ বেদনা তুমি কি তা বুঝনা, পৌঁছে না কান্না কি তোর দরবারে।
নিজাম নামে এক ব্যক্তি করত কত ডাকাতি,খুন করত দিবানিশি মানুষেরই, তবু তুমি তার উপর রাখিলা সুনজর আউলিয়া দপ্তরের নাম লিখলাতারে।
শুনেছি কোরআনে দেখি নাই নয়নে, কুল মিন মুমেনের অন্তরে, পাইতে তোমার দরশন মনে বড় আকিঞ্চন করে দাও আশা পূরণ সিদ্দিক রে।
এ ছাড়া আরো অনেক গান রয়েছে,
১.কত কষ্ট করলেন রাসূল দিনের কারণে। দন্ত্য শহীদ হইল নবীর উহুদের ময়দানে।
২. এসেছি ওয়াদা করে দিয়েছি ভঙ্গ করে, পরিয়া এই মায়ের পেরে সবই হারাইলাম। কি করিতে আইলাম ভবে কি করে গেলাম।
আবু সিদ্দিক বলেন,
বাবা মরে গেছে শুনে কিছু বুঝি নাই, কিন্তু বুকটা কেমন জানি খালি খালি লাগত… এখনো লাগে।” – জানালেন আবু সিদ্দিক, চোখে জল ছলছল করে।
তিনি আরো বলেন
“আমি কোনোদিন ভাবিনি আমার লেখা গান মানুষের ভালো লাগবে। শুধু মনের আনন্দে লিখতাম। এখন দেখি, গ্রামের ছেলেমেয়েরা আমার গান গায়—এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।”
স্থানীয় মো. সাইকুল ইসলাম জানান,
“আবু সিদ্দিক চাচা একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। আমরা চাই, তাঁর মতো প্রতিভাবান মানুষরা জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পাক। সরকার বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উচিত এমন গীতিকারের পাশে দাঁড়ানো।”
সাংবাদিকতা যদি মানুষের গল্প বলার একটি পবিত্র দায়িত্ব হয়, তবে আবু সিদ্দিকের মতো মানুষের কথা বলা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তিনি শিক্ষা পাননি, কিন্তু জ্ঞান ছড়িয়েছেন; তিনি মঞ্চে ওঠেননি, কিন্তু মানুষের মনে গেঁথে গেছেন।
আমরা কি তাঁকে চিনবো? আমরা কি তাঁর গানগুলো সংরক্ষণ করবো? আমরা কি একদিন বলতে পারবো – হ্যাঁ, এই বাংলার মাটিতে এমন একজন কবি ছিলেন, যাঁর কলমে ঝরেছে প্রেম, যন্ত্রণা, আর অবিনাশী আত্মার কথা?
মন্তব্য