সুমন গাজী, বাকৃবি প্রতিনিধি:
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাসের বহুল আলোচিত আব্দুল জব্বার মোড়ের দোকানপাট স্থানান্তর ও গাছ কাটাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি শুরু হয়েছে নানা মতবিরোধ ও অভিযোগের ঝড়। উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক স্থানে গাছপালা কেটে দোকান পুনঃস্থাপনের ব্যবস্থা করা হলেও, পরবর্তীতে হঠাৎ সেই সিদ্ধান্তে পরিবর্তন এনে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গেট (কেবি কলেজ) থেকে শুরু করে ফসিল মোড় পর্যন্ত নির্মিত হচ্ছে চার লেনের সড়ক। এই সড়ক আব্দুল জব্বার মোড় হয়ে যাবে বলে সড়কের দুই পাশে থাকা দোকানগুলো স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দোকান স্থানান্তরের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয় রেললাইনের বিপরীতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় মন্দির ও জিমনেশিয়ামের দুই পাশের জায়গা। যার অংশ হিসেবে এসব জায়গার উভয় পাশে থাকা বহু পুরনো গাছও কাটা হয়।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শুধু জব্বার মোড়ের এক পাশের দোকানগুলোই জিমনেশিয়ামের সামনের স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে। আর মোড়ের অপর পাশের দোকানগুলো বর্তমান অবস্থান থেকে সামান্য পেছনে সরিয়ে রাখা হবে। অর্থাৎ, রেললাইনের পাশে মন্দিরের সামনে যেসব গাছ কাটা হয়েছে, সেখানে আর কোনো দোকান গড়ে তোলা হবে না।
বিষয়টি ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে তৈরি হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। এতে করে ছাত্র, পরিবেশবাদী সংগঠন, এবং দোকানদারদের মধ্যে প্রশ্ন ও ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। তারা বলছেন, যদি মন্দিরের সামনে দোকান বসানোই না হয়, তবে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মূল্যবান গাছগুলো কাটা হলো কেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মো. ওয়ালিদ হাসান বলেন, ‘ক্যাম্পাসে অবস্থিত প্লাটফর্মের পাশে গাছ গুলো প্রায় ৩০-৫০ বছর বয়সী গাছ ছিলো। সেই গাছগুলো কেটে প্রশাসন দোকান নির্মাণের সীদ্ধান্ত নিয়েছিলো। গাছ কাটার আগে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের সাথে একাধিকবার কথা বলেছে, মানববন্ধন করেছে। বিকল্প চিন্তার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তা আমলে না নিয়ে গাছ কাটা হয়েছে। এখন যদি দোকান নির্মাণের সীদ্ধান্ত বাতিল করা হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমাদের প্রশ্ন, গাছ কাটার আগে সেটা নিশ্চিত করা হলোনা কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ প্রকৃতি ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষার্থে প্রশাসনের উদাসীনতা পরিলক্ষিত।’
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘জব্বার মোড় দিয়ে ফোর লেন রাস্তা থেকে শুরু করে দোকান পেছানো পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনায় ছাত্রদের মতামত নেওয়া হয়নি। মতামত গ্রহণ করলে এমন পরিস্থিতি হয়তো এড়ানো যেত।’
গাছ কাটা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শিশুসুলভ আচরণে হিসেবে অবহিত করে বাকৃবি গ্রীন ভয়েসের সভাপতি মো. বকুল আলী। তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের এমন অপরিপক্ক, শিশুসুলভ পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি। বাকৃবির কেন্দ্রীয় মন্দির সংলগ্ন শতবর্ষী গাছগুলো ও সোহরাওয়ার্দী হলের রাস্তার পাশের বৃক্ষনিধনের বিরুদ্ধে আমরা বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তখন জানানো হয় সরকারি পরিকল্পনায় চার লেনের রাস্তা ও গোলচত্বরের জন্য আব্দুল জব্বার মোড়ের দোকানগুলো স্থানান্তরের জন্য গাছগুলো কাটতে বাধ্য হচ্ছেন। তাহলে রাতারাতি চার লেনের রাস্তার পরিকল্পনা কিভাবে পরিবর্তন হয়ে গেল তার সঠিক তদন্ত করা সময়ের দাবি। বাকৃবির পরিবেশ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সদিচ্ছার ঘাটতি লক্ষ্য করছি। উন্নয়ন পরিকল্পনাকে ঢাল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গায় বৃক্ষনিধন পরিবেশের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। যে গাছগুলো আছে সেগুলো কি আদৌও বাকৃবির আলো-বাতাসে শিরদাঁড়া উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে তাই এখন চিন্তার বিষয়।’
দোকান ভাঙা নিয়ে পূর্ব পাশের দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের বিভিন্ন অভিযোগ। জব্বার হোটেলের মালিক মাহবুব আলম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর দোকান এইটা, এখন রাস্তার ঐ পাশে জিমনেশিয়ানমের সামনে যেতে হচ্ছে। দোকানটা বসার কথা মিলনের হোটেল আর জিমনেশিয়াম এই দুইটার মাঝামাঝিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পাশের হলগুলোর ছাত্ররা সাধারণত এই পাশের দোকানগুলোতে খাবার খেয়ে থাকে, আর পশ্চিম পাশের হলগুলোর ছাত্ররা রাস্তার অপর পাশে খায়। এখন যদি সব দোকান এক পাশে সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে পূর্ব পাশের ছাত্ররাই মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি করোনার পরে দোকানটা নিয়েছি। শুরুতে ২-৩ লাখ টাকা লোকসান গুনেছি। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ব্যবসা দাঁড় করাতে প্রায় দুই বছর লেগেছে। এখন আবার নতুন জায়গায় গেলে কতদিনে জমে উঠবে বলা কঠিন। আগে যেমন সময় পেয়েছি, এবার তা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া সময় ও ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দোকান সরানোর জন্য আমাদের মাত্র এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নতুন দোকান তো হুট করে হয় না। তিন-চার মাস সময় দিলে আমরা প্রস্তুতি নিতে পারতাম। এখন সময় নেই, জায়গা নেই, দোকান কোথায় বসাবো সেটাও নিশ্চিত না। এখানে ১৪ জন লোক কাজ করত, এখন সবাই বসে আছে। নতুন জায়গায় দোকান চালু করতেও অন্তত দুই মাস লাগবে। এই সময়টাতে আমাদের বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে।’
রাস্তার একই পাশে থাকা এক মুদি দোকানদার বলেন, ‘আমাদের দোকান এখন রাস্তার অন্য পাশে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে কীভাবে দোকান চালাবো, বুঝতে পারছি না। প্রথমত, ওই পাশে তেমন বেচাকেনা হয় না। দ্বিতীয়ত, আমার কাছে নতুন করে দোকান গড়ার মতো টাকাও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে আমাদের কোনো ক্ষতিপূরণও দেওয়া হচ্ছে না। এখন নিজের খরচে পুরনো দোকান ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। আমরা বলেছিলাম দোকান পেছনে সরিয়ে দিলে খুশি হতাম। কিন্তু রাস্তার একদম অন্য পাশে নিয়ে যাওয়া হলে ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাবে, সেই চিন্তায় আছি।’
জিমনেশিয়াম এবং মন্দিরের দুইপাশে গাছগুলো কাটা হয়েছে সেখানে যদি দোকান স্থানান্তর না করা হয়ে তাহলে কেন গাছ কাটা হলো এমন প্রশ্নের উত্তরে এস্টেট শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার ও অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রাপ্ত এস্টেট অফিসার হাবিব মোহাম্মাদ সাইফুর রহমান বলেন, ‘এটি আগের কমিটির পরিকল্পনা অনুযায়ী কাটা হয়েছে। কিন্তু নতুন কমিটির পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করার পরে তারা দেখেছেন মন্দিরের সামনে দোকানগুলো স্তানান্তর করলে বেশ কিছু অসুবিধা হবে।যেমন মন্দির কমিটি অভিযোগ জানিয়েছেন যদি সেখানে দোকান দেওয়া হয় তাহলে সেখানে কোলাহলের সৃষ্টি হবে যা তারা চান না।’
তিনি আরও জানান, ‘গোল চত্বরের যে ডিজাইন হওয়ার কথা আছে মন্দিরের সামনে যদি করা হয় তাহলে গোল চত্বরের আকৃতি বিকৃত হবে যা দেখতে দৃষ্টিনন্দন হবে না এজন্য দোকানগুলো সব জিমনেশিয়ামের দিকে নেওয়া হবে এবং বর্তমানে যে দোকান গুলো আছে সেগুলো ৫-৬ ফিট পেছানো হবে।’
মন্তব্য